রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ১০:০৯ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

তলে তলে কোন অতলে ছুটছে দেশ

মোস্তফা কামাল:
তলের খবর এখনো অতলেই। ওপরে-ওপরে ঘটনার ঘনঘটা। রাজমেহমান লেগেই আছে বাংলাদেশে। এক গ্রুপ যেতে না যেতেই আরেক গ্রুপ। যাতায়াতের এ বাঁকে আমাদের শ্রম পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল। দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের একটা বাজে সময়ে ঢাকা সফরে তারা। তারা ১২ নভেম্বর আসবেন এবং ৫ দিন থাকবেন বলেই দিনকয়েক আগ থেকে মজুরি বাড়ানোর দাবি নিয়ে গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলনের ছক সাজানো কি-না; এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সরকার নিশ্চিত এর পেছনে নোংরা রাজনীতি রয়েছে। মালিকরাও সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়ায় কারখানায় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু, তা ক’দিন! এ কয়েকদিনে কাহিল তারাও। খেয়ে না খেয়ে শ্রমিক-কর্মীদের অবস্থা আরও করুণ। পোশাকশিল্পকে ঘিরে যারা চক্রান্ত করছে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে এবং কারখানা চালানোর জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে সরকারকে বলেছে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। তাদের দাবি করার আগেই সরকার গার্মেন্টস অধ্যুষিত অঞ্চল নারায়ণগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া, চট্টগ্রাম ও টঙ্গী এলাকার কারখানাগুলোতে ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। হতাহতের ঘটনার পর চলছে কড়া নজরদারি।

স্যোশাল মিডিয়ার ইউটিউবারদের জন্য এ সময়টা বেশ লাভজনক। হাবিজাবি বকে মানুষকে প্রলুব্ধ করে হিট বাড়িয়ে বাড়তি কামাইয়ের লোভে দিওয়ানা তারা। রাজনীতি-কূটনীতির এ গরম মৌসুম বুঝে দেশের ভেতর ও বাইরের কিছু ইউটিউবার নানা গরম কথায় মুখরোচক ব্যাখ্যায় দর্শক বাড়িয়ে নিজেদের ব্যবসা লুটছে। আন্দোলনেরও সাড়ে সর্বনাশ করেছে। তাদের মতলব রাজনীতির লোকদের অনেকের বোঝার বাইরে। বুঝের এ ঘাটতির কারণে নিজে বিভ্রান্ত হচ্ছেন, অন্যকেও তা করে ছাড়ছেন। অক্টোবরে দেশ নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়বে বলে কী বিভ্রান্তই না করা হয়েছে মানুষকে। এর জেরে আন্দোলনের স্পিড এবং স্পিরিট দুটোই আরেক বাঁক নিয়েছে।

রাজনৈতিক কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মার খাচ্ছেন, আর ইউটিউবাররা দূরে বসে ঘি মধু খেয়ে নিরাপদ জীবনযাপন করছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস দিল্লি গেছেন মর্মে উত্তেজনায় কত কনটেন্ট বানিয়ে ছেড়েছে এই ইউটিউবার ও ফেসবুকার সম্প্রদায়। এরা কার পক্ষে বা বিপক্ষে বোঝা মুশকিল। বিভক্তি তৈরি ও টিকিয়ে রাখায় কামিয়াবি এ সম্প্রদায়টি অবশ্য আওয়ামী লীগ-বিএনপি ছাড়া আর কাউকে দেখে না। এর মধ্যে চরম দৃষ্টান্ত রেখেছেন ভারতীয় সাংবাদিক চন্দন নন্দী। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে সরকার পতন, স্যাংশন, ভিসা বাতিলের তথ্য দিয়ে গেছেন একের পর এক। এগুলো মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে। তার সবশেষ ঘোষণা ছিল- ৩ নভেম্বর শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ছেন। চন্দন নন্দীর লেখায় অতিমাত্রায় উল্লসিত হয়েছে সরকারবিরোধী মহল। কিন্তু তারা বুঝে উঠতে পারেননি চন্দন নন্দী জার্নালিজম করেননি। করেছেন সেনসেশনালিজম।

আবার বড় দু’দল আওয়ামী লীগ-বিএনপিও নিজেদের ছাড়া অন্যদের গণনায় ধরতে নারাজ। দেশের সব মানুষ আওয়ামী লীগ বা বিএনপি করে না। বিএনপি রাজপথে পারেনি। শরীরে-অশরীরে মার খেয়ে চলছে সরকার পক্ষের কাছে। আর সরকার তার কর্মী-সমর্থকদের বাইরে সবাইকে প্রতিপক্ষ বিএনপির কর্মী বানিয়ে তাদের দেখে নিতে চাচ্ছে। দলের কর্মী-সমর্থকদেরও সেভাবে অভ্যস্ত করে তুলেছে সরকার এবং আওয়ামী লীগ। তাই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কী ভাবে, চীন কী চায়, ভারত কী করবে কাঙালের মতো এসব তালাশ করতে হচ্ছে বাঙালদের। নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশ বা দেশের জনগণ কী ভাবে তা জানার যেন দরকারই নেই। এতে দেশ কোথায় যাচ্ছে? আলোতে ফিরছে না, আরও আঁধারে ছুটছে; তা ভাবার সময়ও দেওয়া হচ্ছে না। অথচ চোখের সামনেই ঘটছে কত কিছু। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো যে মানুষখেকো গাছে পরিণত হয়েছে তা দেখার চোখ হারিয়েছে প্রায়। মাফিয়া, লুটেরা ও পাচারকারী দানবদের লুটপাটের আকৃতি যে কত বড় হচ্ছে, মানুষকে সেই ভাবনার ফুরসতও দেওয়া হয় না। মোটকথা এগুলো কোনো বিষয়ই নয়। বিষয় হচ্ছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-চীন কোনদিকে। এছাড়া রাজনীতির বাইরে অর্থনীতি, মূল্যস্ফীতি, অগ্নিকা-, নানা দুর্ঘটনা, অন্তর্ঘাতসহ কত কিছু ঘটছে, কত ঘটনা আবার তলানিতে পড়ে যাচ্ছে। মানুষও ভুলো মন, দিব্যি ভুলে যাচ্ছে। অথবা এক ঘটনার তোড়ে আরেক ঘটনা হারিয়ে যাচ্ছে।

পর্দার আড়ালে বা কথিত তলে তলের আসল খবর তাৎক্ষণিক জানা যায় না। জানতে অনেক সময় লেগে যায়। কখনো কখনো মাস-বছর পরও সব ঘটনার নেপথ্য জানা হয় না। তলের বাইরে মানে ওপরের সব কথা বা তথ্য বুঝতেও অনেক সময় গড়িয়ে যায়। বিএনপির মতো বড় দলের বাইরে ছোট দলগুলোর হালে মাঠে বোল দেওয়ার ঘটনাও রহস্য জগতেরই বিষয়। পীর চরমোনাইর হুঙ্কারও কি স্পষ্ট? রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির আগে কোনো অবস্থাতেই তফসিল ঘোষণা না করার দাবি জানিয়েছে তার ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সমঝোতা ছাড়াই নির্বাচন কমিশন একতরফা তফসিল ঘোষণা করতে চাইলে তফসিল ঘোষণার দিন ঢাকায় নির্বাচন কমিশন অভিমুখে গণমিছিল করার আগাম কর্মসূচি দিয়ে রেখেছে দলটি। আন্দোলনরত অন্যান্য বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ সব কর্মসূচির প্রতি ইসলামী আন্দোলনের পূর্ণ সমর্থন থাকবে বলেও জানিয়েছেন সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম। অন্যরাও কম যাচ্ছে না। ‘কেউ চাইলেও দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়’ এমন কথা কীভাবে উচ্চারণ করলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের! তিনি বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী আইনকানুন আছে, কিন্তু ইলেকশনের নামে সিলেকশন হচ্ছে। পরিষ্কার করতে গিয়ে আরও বলেছেন, ইংরেজি ডিকশনারিতে নির্বাচন কথাটার দুটো অর্থ হলো সিলেকশন ও ইলেকশন। আমরা সিলেকশন চাই না, ইলেকশন চাই।’

জিএম কাদেরের মতো নতুন আরও বহু কথা রয়েছে আরও কারও কারও কাছে। কম-বেশি তাদের সবার কাছেই দেশি-বিদেশি তলের কিছু খবর থাকেই। ঝাঁকে ঝাঁকে ধরার পর জেলে থাকা বিএনপি নেতাদের কাছেও কিছু খবর চলে যায়। তাদের ওপর দমন-পীড়নের ব্যাপকতায় জাতিসংঘের উদ্বেগ জানানোর কথাও তারা জানেন। আরও জানেন এ ধরনের উদ্যোগের পূর্বাপরও। এর মধ্যেই ঘনিয়ে আসছে নির্বাচন। সরকারের ঘোষণা যে কোনো মূল্যে সংবিধানের আলোকেই হবে সামনের সংসদ নির্বাচন। একদিকে সরকারের হার্ডলাইন এবং সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখার অপেক্ষা থেকে এখনো সরেনি যুক্তরাষ্ট্র। উপরন্তু বলেছে, তারা এখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুব কাছ থেকে দেখছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিক্রিয়া ভাষাগতভাবে আরও কড়া। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে বাংলাদেশ কর্র্তৃপক্ষের কাছে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচারের জবাবদিহি চাইতে বলেছে অ্যামনেস্টি। বিবৃতিটি আবার তাদের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এমন অতি মতিগতির পথে ভারত তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে। শুক্রবার ভারত আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিদেশ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের ‘টু-প্লাস-টু’ বৈঠকে বাংলাদেশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভারতের বিদেশ সচিব ভিনয় কোয়াত্রা। তিনি বলেছেন, একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে সেদেশের মানুষ যেভাবে দেখতে চায়, সেই ‘ভিশন’কে ভারত কঠোরভাবে সমর্থন করে। তিনি এটাও বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন সেদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং সেদেশের মানুষই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ভিনয় কোয়াত্রা জানিয়ে দেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সেদেশের মানুষ তাদের সংবিধান মতো নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’ ভারতের বার্তা পরিষ্কার। বাকিটা জানুয়ারির অপেক্ষা। এর আগের সময়টায় কী হবে বা হতে পারে? এরইমধ্যে সহিংসতা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। এর সূচনা ২৮ অক্টোবরে। সেদিন ঢাকায় লাখ লাখ লোকের সমাবেশ ঘটিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। উপরন্তু, গত কয়েক বছরের অর্জনও দৃশ্যত চলে গেছে বিসর্জনে। দলের শীর্ষ নেতারা একে একে কারাবন্দি। বাদবাকিরা ফেরারি। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আবার তালা। দৃশ্যত সরকার নির্ভার। রিলাক্সে এগোচ্ছে নির্বাচনের পথে, প্রয়োজনে তা বিএনপিকে বাদ দিয়েই। বিএনপি ভাঙার আয়োজনও ব্যাপক। কিন্তু, তলে তলে সরকারের সেই রিলাক্স কদ্দুর? শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে ২০১৪-’১৮ সালের মতো একতরফা নির্বাচন?

নানামুখী এত প্রশ্নের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বাড়তি প্রশ্ন ‘বাংলাদেশে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম, নীতি-আদর্শ, আমি জানি না আদর্শ-নীতি গুলিয়ে গেল কেন? চরমপন্থি, ডানপন্থি জামায়াতে ইসলামী থেকে শুরু করে বামপন্থি কমিউনিস্ট থেকে শুরু করে এতদিন যারা আদর্শের কথা বলেছে, তারা সব একই সঙ্গে, একই সুরে, একই কথা বলে কীভাবে? তারা এক হয়ে মিলেছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ অপরাধটা কী করেছে, সেটা জানতে চাই। দেশবাসীর কাছে প্রশ্ন, আওয়ামী লীগের অপরাধ কী?’

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট

mostofa71@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION